খন দেবেন্দ্রপুর রেলস্টেষন নামিলাম তখন প্রায় রজনি আধার কাটিয়া যাইতেছে। মাঝে মাঝে পথের ধারের বিরাটাকার বৃক্ষগুলোর মগডাল হইতে দু-চারটা রাতজাগা পাখি দ্বিধার সুরে ডাকিয়া উঠিতেছে। ভোরের আলো তখনো ফুটিয়া উঠেনি, পথঘাট খুব একটা দেখা যাইতেছিল না। বন্দী শহরের বদ্ধতা থেকে কোনরকমে পালাইয়া আসিয়াছি, ফেরার পথে লন্ঠন্টা আনার প্রয়োজন বোধ করিনি। অবশ্য প্রভাতের আধো চাঁদোয়া আর আবছা আলো-আধারিতে খুব একটা খারাপ ও লাগিতেছেনা। জীবনটাই আমার আঁধারে ভরা, খনিকের এই আলো দিয়া এমন আর কিইবা হইবে? তাহার চাইতে প্রকৃতির আধারের সাথে নিজেকে মিশাইয়া লই তাহাই ঢের ভালো।
ভাদ্রের হিমশিতলে কনকনে একটা হাওয়া থেকে থেকে চমকাইয়া দিয়া যাইতেছে যেন আমার সাথে প্রথম প্রেমের সখির স্পর্শ খেলায় মাতিয়া উঠিয়াছে। পথঘাট কেমন যেন এলোমেলো ঠেকিতেছে। পূর্বের সাথে মিলাইতে থাকিলাম কিন্তু কিছুই পরিচিতের বঁড়শিতে ঠোকড়াইতেছেনা। স্টেশন ছাড়িয়া ক্রোশখানিক পূর্বে হাটিলে প্রকান্ড একটা বটগাছ এর সাথে সাক্ষাৎ হইবার কথা অমূলক কিছু নয় কিন্তু কোথাও তার টিকিখানি খুঁজিয়া পাইলাম না যেথায় দু-দন্ড শান্তি বৈঠক দিব বলিয়া ভাবিয়া রাখিয়াছিলাম! অবশ্য হরিশঙ্করের খামারটা দৃষ্টিগোচর হইলো।
আরো ক্রোশখানিক পথ অতিক্রম করিয়া যখন রাধাশঙ্করের নির্জন বাড়িটার সামনে আসিয়া দাড়াইলাম তখন ভোরের আলো অনেকখানিই ফুটিয়া উঠিয়াছে। গ্রামের ঠিক মধ্যিখান বরাবর শিব মন্দিরটা আজো ঠিক স্থানেই রহিয়াছে বুঝিতে পারিলাম ঠাকুরের ধর্মবানির অশনি ধবনি শুনিয়া। এতটা বছর পর আচ্মকা আসিয়া পড়িয়াছি। সেইদিন্কার এত আপন লোকটি আজ আমি এই বাড়িময় সকলের কাছে আগন্তুক। তাই বাড়ির লোকদের ডাকিয়া তুলিবার সাহস পাইলাম না। হঠাত পেছন হইতে সালাম শুনিয়া ফিরিয়া তাকাইলাম, অদ্ভুত দৃষ্টিতে বৃদ্ধলোকটি আমাকে খুঁটিয়া খুঁটিয়া দেখিতে লাগিলো! অসস্থি কাটাইয়া উঠিতে জানিতে চাহিলাম ইহাই রাধাশঙ্করের নিবাস কিনা? জবাবে হ্যাঁ বলিয়া লোকটি চলিয়া গেলো।
রাধাশঙ্কর ছিল আমার বাল্যকালের বন্ধু। ছোটবেলায় মাকে হারাই।প্রচলিত সমাজ ব্যাবস্থার শোষন্ধর্মি নিয়মের কাঠগড়ায় নিজেকে সঁপে দিয়ে এ ভবের রহস্যময়ি খেলা থেকে বাবাও অবসর লইলেন। এরপর থেকেই রাধাশঙ্কর দের কাছেই বাড়ীয়া উঠিয়াছি।
রাধা তার একমাত্র বোন দীপাশঙ্কর এবং তাহার বাবা মা সবমিলিয়ে খুব সুন্দর একটা সাজানো সংসারে আমার বসবাস। সত্যিকার অর্থেই তাহারা আমাকে এত যত্ন করিত যে তাহাদিগকে দেবতা জ্ঞান করিতে আমার এতটুকুও বাধিবেনা। ঠাকুর মশাই ঠিক করিলেন রাঁধা এবং আমাকে উচ্চ শিক্ষার জন্য শহরে পাঠাইবেন, ঠিক ও হইল তাই। এর কিছু দিন অতিবাহিত হওয়ার পর হঠাত ঠাকুর মশাই অসুস্থ হইয়া পড়িলেন। দিনের পর দিন তাহার অবস্থা খারাপ থেকে খারাপ হইতে লাগিলো। আমি আর রাধা ঠিক করিলাম ঠাকুর মশাইকে শহরে নিয়া যাইবো, বড় ডাক্তার দেখাইবো, কিন্তু আজ কাল করিয়া তাহা শুধু বিলম্বই হইতে লাগিলো এর কারন অবশ্য ঠাকুর মশাইয়ের সরল বিচার। নিজ ভিটা ছাড়িয়া কোথাও যাইবেন্না, সুস্থ হইয়া যাইবেন বলিয়া বারবার আশ্বাস প্রধান করিতে লাগিলেন, কিছুতেই তাহাকে রাজি করাইতে পারিলামনা।
এইভাবে প্রায় কুড়িখানিক দিন অতিক্রান্ত হইলো। একদিন বিকেলে দূর সম্পর্কের এক আত্মীয় আসিলেন ঠাকুর মশাইকে দেখিতে, বিছানার পাশে আম্রাও সকলে সেখানে উপস্থিত। তিনি মাসিকে উদ্দেশ্য করিয়া , আমাকে এবং দীপাকে কাছে ডাকিয়া কহিলেন, আমার আর সময় বাকি নেই ভগবানের ডাক পড়িয়াছে এইবার আমাকে যাইতেই হইবে। খুব স্বাদ ছিল খুব ধুমধাম করিয়া এই দুই বাছাদনের সাতপাক শেষ করিব, তাহা বুঝি আর পারিলাম্না। রাধা এবং মাসিমাকে উদ্দেশ্য করিয়া কহিলেন, রাধা ইন্দিরা তোমরা ইহাদের সংসার গড়িয়া দিবে। এ আমার দীর্ঘদিনের খায়েস! এই কথাগুলো তিনি একবাক্যে বলিতে লাগিলেন।
দীর্ঘক্ষন পুরো কক্ষটি জুড়িয়া পিনপতন নিরবতা বিরাজ করিতে লাগিল। দৃষ্টি বুলাইয়া দেখিতে পাইলাম সকলের চক্ষু হইতে বেদনার অশ্রু ঝরিয়া পড়িতেছে।
আমি এতটাই পাষান আর নির্লজ্জ ছিলাম যে দীপাকে পাইবার প্রসন্ন প্রহর শুভাগত দেখিয়া আপ্লুত নয়নে ঠায় দাড়াইয়া ছিলাম, এই বেদনার্ত সুর আমার হৃদয়ের কোথাও যেন এতটুকু দাগ কাটিতে পারেনাই। দূর ছাই জল ,উপরন্তু নির্লজ্জের মত দু চোখের দেয়াল জুড়ে আনন্দের হাসি উপচাইয়া পড়িতে লাগিল, তখনো বুঝিতে পারি নাই এর ফল আমাকে ব্যাথাতুর হাতেই গুনিতে হইবে।
দিন চারেক পর দ্বি-প্রহরের মাথায় ঠাকুর মশাই বিদায় লইলেন। বাড়িময় ক্রন্দনের রোল উঠিল।
শোকের ছায়া মুছিতে না মুছিতেই পিসিমা ব্যতিব্যাস্ত হইয়া উঠিলেন ঠাকুর মসাইএর শেষ ইচ্ছাটা পূরন করিবার জন্য। পরে অবশ্য ঠিক হইলো শহর হইতে উচ্চ শিক্ষা শেষ করিবার পর-ই সানাই বাজিবে, এতে আমার কোন আপত্তি ছিলনা। প্রথমে একটু খারাপ লাগিলেও ভবিষ্যৎ এর কথা ভাবিয়া আর কথা বাড়াইবার প্রয়োজন বোধ করিলাম্না। দীপার ও খুব একটা আপত্তি আছে বলিয়া মনে হইলো না।
সূর্যের দেহখানা যখন পশ্চিমাদেশে প্রায় গাড়িয়া বসিয়াছে তখন দীপার ঘরে প্রবেশ করিয়া দেখি চৌকাঠের ধার ঘেষিয়া বাহিরে দৃষ্টি ফেলিয়া ঠায় দাড়াইয়া আছে। পাশে গিয়া যখন বসিলাম তখন এক ফোটা জল আমার হাতের উল্টাপিঠে গড়াইয়া পড়িল।
আলতো করিয়া জল মুছিয়া বলিলাম পিতৃশোকে বিহবল হইয়া আমাকে কি ভুলিতে বসিয়াছে ? প্রতিউত্তর না দিয়া দীপা ধিরলয়ে গিয়া জানালার চৌকাঠ ধরিয়া দাড়াইলো। পাশে গিয়া বলিলাম, দীপা তোমার দুঃখ গুলি আমার উপর ঢালিয়া দাওতো, তোমার এমন গুম্রাটে মেঘের মত মুখ্খানা আমার অন্ত বাড়িতে প্রলয় ঘটাইয়া যাইতেছে। খালি একবার হাসিয়া দেখ দেখিবে বর্ষন মুখর সন্ধ্যাটাও প্রভাতের স্নিগ্ধতায় হাসিয়া উঠিবে। দীপার খুব একটা ভাবান্তর হইল বলিয়া মনে হইল না। কিছুক্ষন চুপ থাকিবার পর দীপা ঘুরিয়া দাঁড়াইল, হঠাত আমার দুহাত টানিয়া লইয়া দু ফোটা অশ্রুজল বিসর্জন দিয়া প্রনয়াসিক্ত অশ্রুজলে আধো কন্ঠে বলিল ‘ পিতৃমহাশয় আমাদের ছাড়িয়া গিয়াছেন,কদিন যাইতে না যাইতেই তুমিও আমায় ফেলিয়া যাইতেছ! ?
দেখি সত্য করিয়া বলত তোমরা এত পাষান হও কি করিয়া? বলিতে পার আমি একলা থাকিব কেমন করিয়া? দীপার অশ্রুঝরা আখিজোড়ার দিকে তাকাইয়া, তার ভালোবাসার গভীরতার কাছে নিজেকে অতিক্ষুদ্র মনে হইল। আমি বুঝিয়া উঠিতে পারিনাই, আমাকে দূরে পাঠানোর এই ক্ষনিকের একাকিত্ততার কথা ভাবিয়া দীপার অন্তর্ধান জ্বলিয়া ছাই হইতেছে! নিজেকে বড় সুখি মনে হইল, মনে হইল মৃত্যুর পূর্বেই সর্গের স্বাদ পাইয়াছি।
এই মনোহরিনির ভালোবাসা মূহুর্তের জন্য আমাকে যেন বসন্তের বাতাসে ধোলাইতে লাগিল। দীপার ঘর হইতে বিদায় লইবার সময় দীপা আমার হাতে তার একখানা ওড়না বাধিয়া দিয়া কহিল ‘এ আমার হৃদয় খানা বাধিয়া দিলাম, যতনে রেখো’ । অজান্তেই এক ফোটা অশ্রু ঢালিয়া আসিলাম দীপার শিতল মেঝেতে।
পরদিন প্রত্যুষে বিদায় লইবো তাই পিসিমা আমার শোবার ঘরে কাজের লোক পাঠাইলেন সব গোছাইয়া দিতে, আমি ছুটিলাম ঘাটের দিকে। রাধাকেও ডাকিয়া লইলাম। সবেমাত্র প্রথম ডুব দিয়া উঠিলাম শুনিতে পাইলাম খুব ব্যাস্ত গলায় পিসিমা রাধাকে ডাকিছেন।
দাত মাজিতে মাজিতে রাধা সেদিকেই ছুটিল। আমি স্নান শেষে আসিয়া দেখি আমার বিছানার ধারে রাধা গম্ভির মুখে বসিয়া আছে। আয়নাটা সামনে টানিয়া লইয়া চুল আছড়াইতে আছড়াইতে বলিলাম, কিরে রাধা আট্টাতো প্রায় বাজিতে চলিল, দশটায় ট্রেন ধরিতে হইবে, এখনো বসিয়া আছিস? উত্তর না পাইয়া কাছে গিয়া বসিলাম। বন্ধুসুলভ আচরনে কাধে হাত রাখিয়া বলিলাম, কিরে রাধা বাড়ি ছাড়িয়া যাইবি বলিয়া মন খারাপ হইতেছে? এক ঝটকায় হাত ছাড়াইয়া নিয়া রাগত সরে বলিল, ‘শেষ পর্যন্ত এত বড় নিমোক হারামি করলি? স্বয়ং ভগবানও তোকে আশ্রয় দেবেন্না’। কিছুই বুঝিলাম না। কিছু বলিতে যাইবো তখনি দেখি রাধা আমার দীপার হৃদয় খানি, দীপার দেয়া ওড়না খানি হাতে তুলিয়া লইয়া কহিল “ছিঃ এই তুই বিশ্বাসের ফল ঘটাইলি? ছিঃ”। বুঝিতে আর কিছুই বাকি রইল না। চিৎকার করিয়া কহিলাম “রাধা অতবড় অপবাধ তুই আমায় দিস্নে, এ যদি আমি করিয়া থাকি তো ধর্মাবতার যেন আমার মস্তক কাড়ীয়া লন, ইহা তোর ভুল ধারনা...” বাকি টুকু আর বলিতে পারিলাম না, রাধা আমার মুখ চাপিয়া কহিল ‘হয়েছে ধর্মের দোহাই দিয়া মুখের কালিটাকে আর লেপ্টে দিস্না, চিৎকার করে পাড়ার লোক ডাকিয়া আমদের মাথা ছোট করিস্না, যত দ্রুত পারিস এই বাটির আঙ্গিনা হইতে তোর ছায়া ঘুটাইয়া ল’। এত দ্রুত সে কথা গুলো বলিয়া চলিল যে মাথামুন্ড কিছুই বুঝিতে পারিলাম্না। আমি এত দূর্ভাগাই ছিলাম যে পিসিমাকেও প্রনাম করিয়া আসার সোভাগ্য হইলনা। চৌকাঠের বাহিরে পা ফেলিয়া একবার পেছন ফিরিলাম উপরের ঘরে বারান্দায় দেখিলাম দীপা ঠায় দাড়াইয়া অশ্রু বিসর্জন করিতেছে।
আজ ১৯ বছর পর আসিয়া সেই জানালায় চোখ রাখিলাম। জির্ন কাঠের গুড়ি ছাড়া ইহাকে আর কিছুই মনে হইলনা। তবুও মনে হইল শেওলা ধরা স্যাঁতস্যাঁতে করিডোরে দীপা দাড়াইয়া আছে আর আমার দিকে করুন দৃষ্টিতে তাকাইয়া ভালোবাসার বৃষ্টি বর্ষন করিতেছে। একবার ভাবিলাম উপরের ঘরটি ঘুরিয়া আসিব, কিন্তু মন খুব একটা সায় প্রদান করিল না। সে ঘরে আর কেউ প্রদীপ জালাইবেনা, নিচু সরে গান গাহিবে না, বিকেলের আলোতে জানালার পাশে বসিয়া জামায় ফুল তুলিবে না। ক্ষনিক বাদে এক বৃদ্ধ লোক আমার সামনে আসিয়া দাড়াইল। খুব অবাক হইয়া জিজ্জেস করিল ‘কেগো তুমি ? কাকে চাও? এমন প্রাত কালে এইখানে দাড়াইয়া আছ? তোমাকে তো বাপু খুব একটা দেখিয়াছি বলিয়া মনে হইতেছেনা’।নিশ্চুপ থাকিয়া কিছু না উত্তর করিয়া শুধু জিজ্ঞাসিলাম ‘রাধা শঙ্কর বাবু আছেন?’ বৃদ্ধটি বলিল “উনি ত বহু বছর পূর্বেই এই ভিটা বেচিয়া গেছেন, কোথায় গেছেন তাও ঠিক বলিতে পারিনা। কিন্তু তুমি কেহে বাপু?"
এইবারো উত্তর না করিয়া জিজ্জেস করিলাম ‘শঙ্করবাবুর মা, দীপা শঙ্কর তাহারা কোথায়?’ বৃদ্ধটি কি স্বাভাবিক ভাবেই না বলিয়া চলিল ‘ভগবান দুজনকেই কাড়িয়া লইয়াছেন’। মাথায় যেন সারা আকাশ্ময় ভাঙ্গিয়া পড়িল। চারিদিকে প্রভাতের আলো ততক্ষনে স্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছে কিন্তু আমার দৃষ্টিতে দেখিতে পাইলাম চারিদিক বর্ষন মুখর সন্ধ্যার মত অন্ধকার হইয়া আসিল। আর কথা না বাড়াইয়া পরিচিত সেই ভূমি হইতে প্রস্থান করিলাম।
জনহিন এ ভিটায় জ্যোৎস্নায় রাত্তিতে এ উঠোনে আর কোনদিন ঝি ঝি ডাকিবে না, গভীর রাতে পেছনের গহিন বনে ডুমুরেরে ডালে আর লক্ষ্মীপেঁচা ডাকিবেনা। জঙ্গলে চাপা পড়া দীপার হাতে লাগানো বিলাতি লেবু গাছটার সন্ধান আর কেউ কোন দিন পাইবেনা, বেলী গাছটার তলটা আর কেউ মাড়াইবেনা, ওড়কল্মির ফুল ফুটিয়া আপনা আপনিই ঝরিয়া যাইবে। হলদে ডানার পাখিটা শেওলা ধরা ছাদের কোনে একাই কাঁদিয়া ফিরিবে।
একসময় এ সারা বাটিময় বাড়ির চারপাশে আমি আর দীপা ঘুরিয়া বেড়াইতাম। অভিমানের সুরে তুমি নির্জন ঘরের জানালাটায় দাঁড়াইয়া থাকিতে, সেই মূহুর্তটুকুতে আমার ভালোলাগিত্না, কিন্তু অভিমান টুকু তোমার চেহারায় এমন ভাবে ফুটিয়া উঠিত যে না তাকাইয়া পারিতাম না। আর তা বুঝিতে পারিতে বলিয়াই হয়ত পুকুর পাড়ে আমার সাথে ঢিল ছুড়িয়া দূরে ফেলিবার চেষ্টা করিতে, তোমাকে খুশি করিবার জন্য তাই মাঝেমাঝে আমি ইচ্ছে করিয়াই ঢিল কাছে ছুঁড়িতাম। আর মাঝেমধ্যে হারিয়া গিয়া তোমার উচ্ছসিত চোখের জল ঝরঝর করিয়া যখন তোমার গাল বাহিয়া পড়ীত তখন সূর্যের কিরন আসিয়া পড়িতেই তাহা শিশিরের মত চিকচিক করিয়া উঠিত। দুজন ছুটিয়া বেড়াইতাম তোমাদের গ্রামের দেবেষদের বাশবাগানে, ছুটীয়া যাইতাম রায়েদের বটতলায়, ধলুমুনষিদের খেয়া ঘাটে। পীরমাঝীদের মাঠ ছাড়িয়ে, ইছামতি পার হয়ে, পদ্ধভরা কুসুম দীঘির পাশ কাটিয়ে , দেব মহাশয় দের খামার পেরিয়ে ছুটীয়া যাইতাম সীমানা সূদুর। এ নিয়ে পিসিমার কম বকা খাইনি, কিন্তু প্রতিবারি আমিই বাড়ি ফিরিবার জন্য তাড়া দিতাম, সন্ধ্যা ঘনাইয়া আসিলেও তুমি ফিরিতে চাহিতে না, অনুরোধের সুরে কহিতে, “আর কিছুক্ষন থাকিয়া যাই, তাতে বেশ কিছু দেরি হইবেনা” ।
সবকিছুই বর্তমান কে পেছনে ফেলে ছুটীয়া যাইতেছে, সামনে, শুধুই সামনে.... সূর্যদয় ছাড়িয়া সূর্যাস্তের দিকে, জ্যোৎস্না ছাড়িয়া অমাবস্যার দিকে।
দিন রাত্রি পার হয়ে জন্ম থেকে জন্মান্তর, দিন রাত মাস বৎসর মহাযুগ পার হইয়া চলিয়া যায়। আর তোমাকে ঘিরে আমার লালিত সপ্নগুলো হৃদয় দেয়ালে শেওলা ছাতার দলে ঘিরিয়া আসে। পথ আমার তখনো পুরোয় না, চলে চলে ছুটে চলে অনন্তের পথে.........।। সে পথের বিচিত্র আনন্দের অদৃশ্য তিলক পরিয়ে দিলাম তোমার ললাটে।
তবুও আমি ছুটিয়া চলিয়াছি, চলিতে হইতেছে অনন্তের পথে, অজানার পথে লক্ষ্যহীন সীমানায়। বাচিয়া থাকিবার চিরন্তন যুদ্ধে আমরন লড়িয়া যাইতেছি একটি মৃত আত্তাকে সঙ্গি করিয়া, সেই যুদ্ধে তোমাকে সাথে পাইলে এই বিশ্ব ভ্রক্ষান্ড কে চিৎকার করিয়া বলিতাম, “ এই যুদ্ধে বিজয়ির খাতায় সেনাপতির নাম হিসেবে আমার নামটিই দেখিতে পাইতে...”